সবাইকে আন্তরিক সালাম এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। চলুন আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করি।
কম্পিউটার কি এবং কম্পিউটার শব্দের অর্থ আমরা কমবেশি সবাই জানি। তারপরও আবারও সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেই। কম্পিউটার শব্দটি গ্রিক কম্পিউট শব্দ থেকে এসেছে। কম্পিউট শব্দের অর্থ হিসাব বা গণনা করা। এবং কম্পিউটার শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। গণকযন্ত্র বা কম্পিউটার হল এমন একটি যন্ত্র যা সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অনুসরণ করে গাণিতিক গণনা সংক্রান্ত কাজ খুব দ্রুত করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আর কম্পিউটারকে শুধু গণনাকারী যন্ত্র বলা যায় না। কম্পিউটার এমন এক যন্ত্র যা তথ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করে। বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে।
পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন কম্পিউটার গুলো
অ্যাবাকাস
প্রাচীন কালে মানুষ সংখ্যা বুঝানোর জন্য ঝিনুক, নুড়ি, দড়ির গিট ইত্যাদি ব্যবহার করত। পরবর্তীতে গণনার কাজে বিভিন্ন কৌশল ও যন্ত্র ব্যবহার করে থাকলেও অ্যাবাকাস নামক একটি প্রাচীন গননা যন্ত্রকেই কম্পিউটারের ইতিহাসে প্রথম যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ অ্যাবাকাস থেকেই কম্পিউটারের ইতিহাসের শুভযাত্রা। এটি আবিষ্কৃত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ সালে ব্যাবিলনে। অ্যাবাকাস ফ্রেমে সাজানো গুটির স্থান পরিবর্তন করে গননা করার যন্ত্র। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০/৫০০ অব্দে মিশরে বা চীনে গননা যন্ত্র হিসেবে অ্যাবাকাস তৈরি হয়।
১৬১৬ সালে স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার গণনার কাজে ছাপা বা দাগ কাটাকাটি/ দন্ড ব্যবহার করেন। এসব দন্ড নেপিয়ার এর অস্থি নামে পরিচিত।
১৬৪২ সারে ১৯ বছর বয়স্ক ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। তিনি দাঁতযুক্ত চাকা বা গিয়ারের সাহায্যে যোগ বিয়োগ করার পদ্ধতি চালু করেন। ১৬৭১ সালের জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড ভন লিবনিজ প্যাসকেলের যন্ত্রের ভিত্তিতে চাকা ও দন্ড ব্যবহার করে গুণ ও ভাগের ক্ষমতাসম্পন্ন আরো উন্নত যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তেরি করেন। তিনি যন্ত্রটির নাম দেন রিকোনিং যন্ত্র। যন্ত্রটি তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ভাল হলেও যান্ত্রিক অসুবিধার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি।
পরে ১৮২০ সালে টমাস ডি কোমার রিকোনিং যন্ত্রের অসুবিধা দূর করে লিবনিজের যন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তোলেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আধুনিক একটি যন্ত্রের নির্মাণ ও ব্যবহারের ধারণা প্রথম সোচ্চার ভাবে প্রচার করেন চার্লস ব্যাবেজ। তিনি এটির নাম দেন ডিফারেন্স ইন্জিন। এই ডিফারেন্স ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করার সময় ১৮৩৩ সালে তিনি অ্যানালিটিক্যাল ইন্জিন নামে আরও উন্নত ও সর্বজনীন একটি যন্ত্রে ধারনা লাভ করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও অর্থের অভাবে কোনোটির কাজই তিনি শেষ করতে পারেননি।
এন্টিকিথেরা মেকানিজম
১৯০০ সালের গ্রীষ্মকাল। এপ্রিলের দিকে একদল গ্রীক ‘স্পঞ্জ ডাইভার’ অলস ডুব দিচ্ছেন গ্রীসের ‘এন্টিকিথেরা’ দ্বীপের কাছাকাছি একটা জায়গায়। তাদের উদ্দেশ্য দ্বীপের পাশের পানির নিচ থেকে স্পঞ্জ তুলে এনে বাজারে বিক্রি করা। এই ডুবুরীর দল কখনো স্বপ্নেও ভাবেন নি যে তারাই হতে যাচ্ছেন দুনিয়ার সবচেয়ে পুরাতন কম্পিউটারের আবিষ্কারকারী হবেন। কারন আদতে কম্পিউটার তখনো বানানো হয় নি সেভাবে। সাধারন মানুষ তো দূরের কথা এমনকি বিজ্ঞানচর্চার সাথে জড়িত সবাইও জানতো না কম্পিউটার নামক যন্ত্র সম্পর্কে।
তারা ডুব দিলেন সাগরের ৪৫ মিটার বা ১৪৮ ফুট গভীরে। পানির নিচে যাওয়ার পরে তারা লক্ষ্য করলেন আবছা অন্ধকারে সম্ভবত অনেক পুরাতন একটা জাহাজের ভাংগা কিছু অংশ দেখা যায়। আবিষ্কারের উত্তেজনায় তারা উপরে উঠে এলেন। দলের সবাইকে জানালেন। সবাই আবার ডুব দিয়ে নিচে গিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, এই জাহাজটি অনেক অনেক পুরাতন একটা জাহাজ। তাদের স্পঞ্জ তুলে আনার চিন্তা উঠে গেলো। দলের সবাই মিলে পুরাতন জাহাজটা নিয়ে খাটাখাটি শুরু করলেন। জাহাজটার নাম হলো ‘এন্টিকিথেরা শিপর্যাক’। ডুবুরির দল আস্তে আস্তে তুলে আনতে শুরু করলেন ডুবে যাওয়া জাহাজের পুরাতন জিনিসপত্র। কিছু অতি প্রাচীন ব্রোঞ্জ, মার্বেলের মূর্তি, কাঁচের বাসনপত্র, অলংকার, মুদ্রা ইত্যাদি। কিন্তু এরকম জিনিসপত্র স্মরণকালের মাঝে কেউ ব্যবহার করেছে বলে তাদের জানা নেই।
উদ্ধার করা সবকিছু তারা দিয়ে দিলেন এথেন্সের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আর্কিওলজী’ তে যাতে সায়েন্টিস্টরা এসব নিয়ে কাজ করে সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, জিনিসগুলোর পেছনের ইতিহাস বের করে আনতে পারেন। ডুবুরীর দল ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসগুলোর সাথে ব্রোঞ্জ এলয়’র, কতগুলো আধা ভাংগা, এলোমেলো বিছিন্ন কিছু দাঁতওয়ালা চাকা উদ্ধার করে এনেছিলেন। সবগুলো জিনিস মিউজিয়ামে পড়ে রইলো টানা ২ বছরের মত। এর মাঝে মিউজিয়ামের কর্মী ও গবেষকের দল টুকরা টুকরা বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে অনুমান করে একসাথে করতে লাগলেন। ওই দলের এক সদস্য আর্কিওলজিস্ট ভেলেরিস স্টেইস তখনো জানতেন না যে তিনি কত সুপ্রাচীন ইতিহাসের অন্ধকার থেকে কী অসম্ভব এক আবিষ্কারকে বের করে আনতে যাচ্ছেন।
স্টেইস টুকরা টুকরা জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করছেন, মনে মনে একটা টুকরার সাথে আরেকটা টুকরার মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, একটা পাথরের ভেতর একটা চাকা আটকানো। প্রথমে উনি ভাবলেন এটা একটা ‘এস্ট্রোনোমিকাল ক্লক’ বা এর চেয়ে এডভান্সড অন্য কোন কিছু একটা হতে পারে কিন্তু অন্যান্য সাইন্টিস্টরা অমত করলেন। অসম্ভব, এটা হতেই পারেনা। কারণ এতো আগে এইরকম একটা কমপ্লেক্স মেশিন মানুষ কিভাবে বানাবে।
এরই মধ্যে বের হয়ে এসেছে যে, এই জাহাজ মোটামুটিভাবে ঈসা (আঃ) এর জন্মের সময়কার তথা প্রায় ১৯০০ বছরের পুরাতন। তারা আন্দাজ করে নিলেন এই চাকার মত জিনিসটার বয়স আরো কিছু বেশী হতে পারে। তারা ধারনা করলেন এই জিনিসটা ঈসা (আঃ) এর জন্মের কমপক্ষে ১০০-১৫০ বছরের পুরাতন। এতো পুরাতন একটা ব্রোঞ্জের টুকরা গবেষকের দলকে খুব একটা টানতে পারলো না। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন কম্পিউটারকে তারা না জেনেই আবিষ্কার করতে গিয়ে একেবারে কাছ থেকে সরে এলেন।
তারপরে প্রায় ৫০ বছর ব্রোঞ্জের ভাংগা চাকাগুলোর দিকে কেউ নজর দিলো না। পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রইলো এথেন্সের মিউজিয়ামে। ১৯৫১ সালের দিকে ইয়েল ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর, পদার্থবিদ ও বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ ডেরেক জন ডি সোলা প্রাইস ব্রোঞ্জের টুকরাগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখালেন। এই মহান মানুষটা দীর্ঘ অনেক বছর কাজ করলেন এগুলো নিয়ে। এর মাঝে সাথে পেলেন গ্রিক এক নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ কারালাম্পোস কারাকালোসকে। ১৯৭১ সালের দিকে দুজনে মিলে মোট ৮২ টুকরা ভাংগা চাকাগুলোর উপরে এক্স-রে, গামা-রে পরীক্ষা চালালেন। যে ভাংগা টুকরাগুলোকে কেউ পাত্তা দিতে চায়নি সেগুলোকে নিয়েই প্রাইস তার ২০ বছরের বেশী সময়ের গবেষনা আর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ৭০ পৃষ্ঠার এক বিশাল আর্টিকেলে।
প্রফেসর প্রাইস সেই টুকরাগুলোকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ২০০০ বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন সেই কম্পিউটারকে আবারো বানিয়ে দুনিয়ার মানুষকে দেখালেন,
‘দেখো, ২০০০ বছর আগেরকার কম্পিউটার কেমন ছিলো’
প্রাচীন গ্রীসের এন্টিকিথেরা দ্বীপের সায়েন্টিস্টরা তাঁদের এই যন্ত্রকে কি নামে ডাকতেন তা জানা সম্ভব হয় নি, কিন্তু একটা নাম তো দিতেই হয়। প্রফেসর প্রাইসের আবিষ্কার করা দুনিয়ার ইতিহাসের এই মেকানিক্যাল কম্পিউটারের নাম দেয়া হয় ‘এন্টিকিথেরা মেকানিজম’।
আজকের আধুনিক ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের কাছে ঐ কম্পিউটারটা হয়তো কিছুই না কিন্তু ২২০০ বছর আগে মানুষ তার নিজের ডিজাইন করা মেকানিকাল কম্পিউটার দিয়ে তখন মহাকাশ গবেষণায় রত থেকেছে, এটা দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করে নিজেদের ক্যালেন্ডার বানিয়েছে, এমনকি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হওয়া গ্রীক অলিম্পিয়াডের সঠিক সময়ও এই কম্পিউটারই নির্ধারন করেছে। আজকে ২০১৫ সালে কোন ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করার সময় এসব ভাবতেও ভালো লাগে।
বাইনারি লজিক
১৭০৩ সালে গটফ্রিড উইলহেম লিবনিজ তার লেখা বাইনারি সংখ্যা সিস্টেমের একটি প্রথাগত গাণিতিক অর্থে যুক্তির উন্নতি করেন। তাঁর সিস্টেমে এক এবং শূন্য সত্য এবং মিথ্যার মানের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত জর্জ বোল এর গাণিতিকভাবে স্থাপিত গণনীয় প্রসেসের একটি সম্পূর্ণ সিস্টেমের সাথে তার বুলিয়ান বীজগণিত প্রকাশ করতে এক শতাব্দীরও বেশি সময় লেগেছিলো।
এই সময়ে বাইনারি প্যাটার্ন দ্বারা চালিত প্রথম একটি যান্ত্রিক ডিভাইস উদ্ভাবিত হয়েছিল। শিল্প বিপ্লব অনেক কাজের যান্ত্রিকীকরণে এগিয়ে নিয়ে এসেছিল। ১৮০১ সালে জোসেফ মেরী জ্যাকুয়ার্ড -এর তাঁত পাঞ্চ কার্ড নিয়ন্ত্রণ করেছিলো। যেখানে একটি গর্ত একটি বাইনারি এক এবং একটি স্পট কার্ড একটি বাইনারি শূন্য নির্দেশ করে। জ্যাকুয়ার্ডের তাঁত একটি কম্পিউটার থেকে অনেক দূরে ছিল, কিন্তু এটা বাইনারি সিস্টেম দ্বারা চালিত মেশিনকে প্রতারিত করতে পারতো।
কম্পিউটার ও কম্পিউটিংয়ের অন্যতম ভিত্তিমূল
১৯২৬ সালের কথা। ১৪ বছর বয়সী অ্যালান টিউরিংয়ের শেরবর্ন স্কুলের প্রথম ক্লাস। একই দিন যুক্তরাজ্যে চলছে সাধারণ ধর্মঘট। কিন্তু টিউরিং স্কুলে যাবেনই। সে ব্যাপারে তিনি নাছরবান্দা। শেষে নিজের বাইসাইকেলে চড়ে একাকী ৯৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালেন স্কুলে। :O
শেরবর্ন স্কুলে সাধারণত জোর দেওয়া হতো ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা ইত্যাদির ওপর। কিন্তু তার সেদিকে মন ছিল না। টিউরিংয়ের অন্তহীন মগ্নতা ছিল গণিত ও বিজ্ঞানে। তাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাধ্য হয়ে টিউরিংয়ের বাবার কাছে চিঠি লিখলেন এই বলে যে, টিউরিংয়ের ভবিষ্যতে অনেক বড় বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং শেরবর্নে টিউরিংয়ের আর সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না।
এর ১০ বছর পর ১৯৩৬ সালে অ্যালান টিউরিং ‘টিউরিং যন্ত্র’ নামে একটি বিশেষ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এটি কোনো বস্তুগত যন্ত্র নয়, বরং কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ বিশেষ কিছু কার্যনীতি। এই টিউরিং যন্ত্রই আধুনিক কম্পিউটার ও কম্পিউটিংয়ের অন্যতম ভিত্তিমূল। আধুনিক ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের বিকাশ টিউরিং যন্ত্র দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত। ১৯৫৪ সালে অ্যালান টিউরিং মাত্র ৪২ বছর বয়সে সায়ানাইড মিশ্রিত আপেল খেয়ে মারা যান। তবে স্বল্পায়ু জীবনেই তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অ্যালান টিউরিংকে বলা হয় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক।
টিউরিং পুরস্কার
নিউইয়র্কভিত্তিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন কম্পিউটার সমিতি অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি (এসিএম) ১৯৬৬ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক অ্যালান টিউরিংয়ের নামে প্রবর্তন করে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার ‘টিউরিং পুরস্কার’। সভ্যতা ও মানুষের চলার পথকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে কম্পিউটার বিজ্ঞানের এমন সব আবিষ্কার ও গবেষণাকার্যের জন্য প্রতিবছর টিউরিং পুরস্কার দেওয়া হয়। টিউরিং পুরস্কারের ঐতিহ্য, কম্পিউটার বিজ্ঞানে টিউরিং পুরস্কারের সুদূরপ্রসারী প্রভাব, টিউরিং পুরস্কারপ্রাপ্তদের অনন্য সৃষ্টিশীলতা ও বিশ্বব্যাপী এর সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে একে ‘কম্পিউটারের নোবেল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই পুরস্কারের আর্থিক মূল্য দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার।
১৯৬৬ সালে টিউরিং পুরস্কার প্রবর্তনের বছর এই পুরস্কারে ভূষিত হন মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান পারলিস। প্রোগ্রামিং ভাষা ও কম্পইলার উন্নয়নে তাঁর বিপুল অবদানের জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। অ্যালগল নামের বিখ্যাত প্রোগ্রামিং ভাষার তিনি একজন সহ-উদ্ভাবক। ‘কম্পিউটারও শিখতে পারে এবং কম্পিউটারকে চাইলে যেকোনো কিছু শেখানো যায়’—এই ধারণা ও তত্ত্ব প্রদানকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম পথিকৃৎ জন ম্যাককার্থি টিউরিং পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭১ সালে। সি প্রোগ্রামিং ভাষার জনক ও ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের সহ-উদ্ভাবক ডেনিস রিচি টিউরিং পুরস্কার পান ১৯৮৩ সালে। ফ্রান্সিস ই অ্যালেন হলেন প্রথম নারী, যিনি টিউরিং পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৬ সালে এই মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী কম্পইলার ও কম্পিউটারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিবিষয়ক গবেষণার জন্য টিউরিং পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে টিউরিং পুরস্কার লাভ করেন আরেক নারী বারবারা লিসকভ। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের উন্নততর ঘরানা ‘অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং’ উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা ও উন্নততর সফটওয়্যার স্থাপত্যবিষয়ক গবেষণার জন্য তিনি এ পুরস্কার পান। তিনি সিএলইউ ও আরগাস নামে দুটি প্রোগ্রামিং ভাষাও উদ্ভাবন করেন। এশীয়দের মধ্যে প্রথম টিউরিং পুরস্কার লাভ করেন ভারতীয় কম্পিউটার বিজ্ঞানী রাজা গোপাল রাজ রেড্ডি। বৃহৎ পরিসরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রায়োগিক কাঠামো ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাণিজ্যিক দিক নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ১৯৯৪ সালে টিউরিং পুরস্কার লাভ করেন। রেড্ডি তাঁর নিজ দেশে ২০০১ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। গত বছর টিউরিং পুরস্কারে ভূষিত হন মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী লেসলি জি ভ্যালিয়ান্ট। যন্ত্রের শিক্ষণ-তত্ত্ব, সমান্তরাল কম্পিউটিং প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। গত ৪৫ বছরে সর্বমোট ৫৭ জন কম্পিউটার বিজ্ঞানী এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
বাস্তবে যান্ত্রিক ও ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের সাহায্যে গণনাসংক্রান্ত যা কিছু করা সম্ভব, টিউরিং যন্ত্রের সাহায্যেও তার সবকিছুই সম্ভব। বরং বাস্তব কম্পিউটারের সাহায্যে সম্ভবপর নয় এমন অনেক কিছুর বাস্তবায়নও টিউরিং যন্ত্রের সাহায্যে সম্ভব। বিশ্বজুড়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বাস্তব কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা ভালোভাবে বুঝতে শরণাপন্ন হন টিউরিং যন্ত্রের। আর টিউরিং পুরস্কারও কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের বাস্তব কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা দূর করে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ব্যাপারে সদা সততই অনুপ্রেরণা জোগায়।
অতীত থেকে বর্তমানে কম্পিউটার
অতীত থেকে বর্তমানে কম্পিউটার আসতে বেশী সময় লাগেনি। আধুনিক কম্পিউটারের রূপরেখা তৈরি করেন ব্রিটিশ গণিতবিদ
। ১৮২২ সালে তার আবিষ্কৃত 'ডিফারেন্স ইঞ্জিন' কিছু সমস্যার কারণে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আবার তার অনেক পরে ১৮৩৩ সালে তিনি আগের সব গণনাকারি যন্ত্রের স্মৃতিভান্ডারের প্রয়োজনীতা অনুভব করেন। এই প্রয়োজনীয়তার কারনে তিনি একটি যন্ত্র তৈরির চিন্তা করেন, যার নাম দেন “অ্যানালটিক্যাল মেশিন”। এটির কাজ তিনি শেষ করতে পারেননি। তার এই মেশিনের ডিজাইনের উপর ভিত্তি করেই আজকের এই কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছে। এই জন্যই তাকে কম্পিউটারের আদি পিতা বা জনক বলা হয়। তার পরে লেডি আড্যা আগাষ্টা, ফ্রাঙ্ক বন্ডইউন সহ আরো অনেকে এগিয়ে নিয়ে যান চার্লস ব্যাবেজের উক্ত কাজকে।
চার্লস ব্যাবেজ ১৮৮৭ সালে 'ডঃ হরম্যান হলেরিথ' যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারির কাজে ব্যবহারের জন্য ইলেকট্রো মেকানিক্যাল ব্যবস্থায় পাঞ্চকার্ডের সমন্বয়ে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এর দ্বারা দ্রুত আদমশুমারির কাজ করা যেতো। ১৮৯৬ সালে তিনি এ যন্ত্র তৈরির জন্য “হলেরিথ টেবুলেটিং মেশিন কোম্পানী” নামে একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই কোম্পানীগুলো একত্রে তৈরি হল বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান “ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন কর্পোরেশন বা বর্তমানের আইবিএম।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হাওয়ার্ড এইচ. আইকেন ও IBM এর চারজন প্রকোশলীর সহযোগিতায় ১৯৪৪ সালে তৈরি করা হয় প্রথম স্বয়ংক্রিয় সাধারণ ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ডিজিটাল কম্পিউটার Mark-1। এটি ছিল প্রায় লম্বায় ৫১ ফুট, উচ্চতায় ৮ ফুট। এতে ৭ লক্ষাধিক যন্ত্রপাতির জন্য প্রায় ৫০০ মাইল লম্বা তার ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ওজন ছিল ৫ টন, এটি চালু ছিল ১৫ বছর। বর্তমানে এটি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান জাদুঘরে আছে।
১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক 'ডঃ জন মউসলি' এবং তার ছাত্র 'প্রেসপার একার্ড' মিলে তৈরি করেন প্রথম প্রজন্মের ডিজিটাল কম্পিউটার ENIAC। এটি ছিল অত্যান্ত বড় ও ওজনে ছিল প্রায় ৩০ টন। এটি প্রতি সেকেন্ডে ৫০০০ যোগ বিয়োগ করতে পারত।
১৯৪৬ সালে হাঙ্গেরীয় গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান সংরক্ষিত প্রোগ্রাম ধারণাটি উদ্ভাবন করেন। তিনিই প্রথম কম্পিউটারের “তথ্য ও নির্দেশ” সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করেন। তার এই ধারনার উপর ভিত্তি করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মরিশ উইলকশ ১৯৪৬ সালে EDSAC নামে সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক্স ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরি করেন।
ভন নিয়ম্যানের নীতিকে কাজে লাগিয়ে EDSAC তৈরির আগেই ENIAC এর নির্মাতা 'জন মউসলে' ও 'জে. প্রেসপার একার্ট' ENIAC নামে কম্পিউটার তৈরিতে নিয়োজিত ছিলেন। এর মধ্যে তারা একটি কোম্পানী তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন যার কারণে কম্পিউটারটি তৈরি করতে দেরি হয়। ১৯৫০ সালে তারা EDVAC তৈরি করেন।
এরপর 'জন মউসলে' ও 'জে. প্রেসপার একার্ট' নিজেদের কোম্পানীতে ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে UNIVAC-1 তৈরি করেন। এটিই হল সর্বপ্রথম তৈরিকৃত বানিজ্যিক ইলেকট্রনিক কম্পিউটার। এতে ক্রিষ্টাল ডায়োড স্যুইচ ও ভ্যাকুয়েম টিউব সার্কিট ব্যবহার করা হয। এটি এক সাথে পড়া, তথ্য লেখা ও গণনা করতে পারত। প্রথম UNIVAC-1 টি সরবারাহ করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Bureau Of Census অফিসে, দ্বিতীয়টি বিমান বাহিনীতে, তৃতীয়টি আর্মি ম্যাপ সার্ভিস অফিসে। ১৯৫৩ সালে আইবিএম IBM701 নামক একটি বানিজ্যিক কম্পিউটার তৈরি করে। এই সময়ে প্রোগ্রাম রচনা করা হতো বাইনারি ভাষা ব্যবহার করে।
১৯৪৮ সালে ট্রানজিষ্টর আবষ্কারের ফলে বাল্ব এর পরিবর্তে ট্রানজিষ্টার ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যবহারের ফলে কম্পিউটার ধীরে ধীরে আকারে ছোট হতে থাকে। এই কম্পিউটার গুলো ছিল আগেরগুলো থেকে উন্নত, দ্রুত গতিময় ও টেকসই। ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাটমাউথের দু’জন অধ্যাপক J. G. Kemeny এবং Tomas Kurtz এরই মধ্যে বেসিক নামে একটি প্রোগ্রাম রচনা করেন। এ ভাষায় প্রোগ্রাম লেখা অত্যান্ত সহজ হয়ে পড়ে। যার কারণে এটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়।
ট্রানজিষ্টার আবিষ্কারের পরে আবিষ্কার হয় IC বা Integrated Circuit। সিলিকনের একটি ক্ষুদ্র অংশে একাধিক ট্রানজিষ্টার একত্র করে এটি তৈরি করা হয়। আইসি ব্যবহারের ফলে কম্পিউটারগুলা আকারের একদম ছোট হয়ে গেল, তার সাথে বেড়ে গেল গুণগত মান ও দ্রুততর হল কাজের গতি।
কম্পিউটারের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে মাইক্রোপ্রসেসর আবিষ্কারের ফলে। ১৯৭১ সালে আমেরিকার ইন্টেল কোম্পানি সর্বপ্রথম মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি করে। এটি এক বর্গইঞ্চি মাপের সিলিকন পাতের হাজার হাজার ট্রানজিষ্টারের একটি যন্ত্রাংশ। এর ফলে কম্পিউটার হয়ে যায় একটি টেলিভিশনের মতো। এতে কম্পিউটারের দাম চলে আসে হাতের নাগালে, ব্যবহারের সুবিধা বেড়ে যায় ও কাজের ক্ষমতা বেড়ে হয় হাজার হাজার গুণ। এটি দিয়ে তৈরি কম্পিউটারই হল আজকের Personal Computer।
আজ আর না। যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে অথবা বুঝতে যদি কোন রকম সমস্যা হয় তাহলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আপনাদের মতামত আমাকে সংশোধিত হতে সাহায্য করবে। এখানেই শেষ করছি। দেখা হবে আগামী....................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন